বিশ্ব জুড়েই কেন বাড়ছে পুরুষদের স্তন ক্যানসার !



তাদেরও যে এই রোগটার ঝুঁকি রয়েছে, সে কথা জানেনই না অধিকাংশ পুরুষ! তাই অস্বাভাবিকতা দেখলে গোড়াতেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেন না তারা। তাদের জন্য গড়ে ওঠেনি কোন ‘সাপোর্ট গ্রুপ’ও। অথচ অ্যানথ্রোপলিজক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ধরা পড়েছে, সমস্যার রেখচিত্রটা যথেষ্ট উপরের দিকে। পুরুষদের স্তন ক্যানসার নিয়ে ওই গবেষণা ভাঁজ ফেলেছে চিকিৎসকদের কপালেও।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সারা বিশ্বে যত স্তন ক্যানসারের রোগী পাওয়া যায়, কিছু দিন আগে পর্যন্ত তার এক শতাংশ পুরুষ বলে জানা যেত। ইদানীং সেই সংখ্যাটা দুই থেকে তিন শতাংশ হয়েছে। যে কোন বয়সের পুরুষেরা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। মহিলাদের স্তন ক্যানসারের মতো পুরুষদের স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রেও পরিবেশগত এবং জিনগত কারণ রয়েছে। পরিবারে কারও স্তন ক্যানসার হয়ে থাকলে সেই পরিবারে মেয়েদের পাশাপাশি পুরুষদেরও ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যায়।

পরিস্থিতি কী, তা বুঝতে ভারতের দুটি হাসপাতাল (ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ এবং ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল) থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন সমীক্ষকেরা। তারা বেছে নিয়েছিলেন বাঙালি, হিন্দু পুরুষদের। দু’বছরে মাত্র দুটি হাসপাতালেই ৩৬ জন পুরুষ স্তন ক্যানসার রোগীর সন্ধান পান তারা। সংখ্যার বিচারে যা অনেক বেশি বলেই মেনে নিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের শিক্ষক অরূপরতন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অ্যানথ্রোপলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সুপারিন্টেন্ডিং অ্যানথ্রোপলজিস্ট বিশ্বনাথ সরকারের তত্ত্বাবধানে মূল গবেষণাটি করেছেন অভিষিক্তা ঘোষরায়। অভিষিক্তার কথায়, ‘পুরুষদের স্তন ক্যানসারের কারণটা বুঝতে চেয়েছিলাম আমরা। দেখা গেল, জিনের ভূমিকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহিলাদের স্তন এবং ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ক্ষেত্রে বিআরসিএ-১ এবং বিআরসিএ-২ জিনের মিউটেশনের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু পুরুষদের স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে বিআরসিএ-১ জিনের প্রভাব অনেক কম। বিআরসিএ-২-এর প্রভাবই বেশি। শুধু তাই নয়, বিআরসিএ-২ জিনের নতুন এক ধরনের মিউটেশনেরও প্রমাণ মিলেছে।’ এরই পাশাপাশি, দেহের অতিরিক্ত ওজন, চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, হরমোনের ওষুধ খাওয়া, অতিরিক্ত ধূমপানও এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।

চিকিৎসকদের মতে, পুরুষদের স্তনে যেহেতু টিস্যু কম, তাই টিউমার হলে তা সহজে ধরা পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু অজ্ঞতাটাই কাল হয়েছে তাদের। রাজ্যের সবচেয়ে বড় সরকারি ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট থেকে জানা গিয়েছে, ওই কেন্দ্রে মাসে অন্তত তিন থেকে চার জন পুরুষ স্তন ক্যানসারের রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই আসছেন দেরিতে। বেসরকারি হাসপাতালেও ডাক্তারদের অভিজ্ঞতাটা কম-বেশি একই। যেমন, কয়েক বছর ধরে বুকে একটি ব্যথাহীন মাংসপিণ্ড ছিল কলকাতার একটি নামী কলেজের প্রবীণ অধ্যাপকের। কিন্তু বিষয়টিকে তেমন গুরুত্বই দেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত যখন জায়গাটি ক্রমশ লালচে হতে শুরু করল, মাঝেমধ্যেই শুরু হল সামান্য রক্তক্ষরণ, তখন বাধ্য হয়েই তিনি চিকিৎসকের কাছে গেলেন তিনি। পঁয়ত্রিশ পেরনো ব্যাংক ম্যানেজারও বছর দু’য়েক ধরে স্তনের কাছে শক্ত একটি মাংসপিণ্ডকে গুরুত্ব দেননি। যখন চিকিৎসকের কাছে গেলেন, তখন রোগটা ছড়িয়েছে অনেকটাই। ডাক্তাররা প্রশ্ন করলেন আরও আগে আসেননি কেন? যুবক বলেছিলেন, “এ সব রোগ তো মেয়েদের হয়! ছেলেদেরও যে হয়, সেটা কীভাবে জানব?”

ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘শুধু সাধারণ মানুষ কেন, অনেক ডাক্তারও জানেন না যে পুরুষদের স্তন ক্যানসার হতে পারে। তাই অনেকের ক্ষেত্রেই রোগটা ধরা পড়ে দেরিতে।’ একই কথা বলেছেন ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, ‘মহিলা ও পুরুষদের স্তন ক্যানসারের উপসর্গ এক। অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি-র মতো চিকিৎসা প্রক্রিয়া পেরোতে হয় মহিলাদের মতো পুরুষদেরও। কিন্তু সচেতনতার অভাব সমস্যাটা বাড়িয়ে তোলে।’

ব্রেস্ট কনসালট্যান্ট তাপ্তী সেন জানান, সাধারণভাবে তার কাছে স্টেজ টু-তেই আসছেন পুরুষ রোগীরা। তবে কোন কারণে আসতে আরও দেরি করলে রোগটা অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার ভয় থেকে যাচ্ছে।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

Share this

Related Posts

Previous
Next Post »