দিলরুয়ান পেরেরার বলে মুশফিকের রিভার্স সুইপ। গ্যালারির বাংলাদেশ সমর্থকেরা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। জয়ের জন্য তখন বাংলাদেশের দরকার ৪ রান। মুশফিকের সেই শট বাউন্ডারি হতে যাচ্ছে ভেবেই উল্লাস। হলো না। তবে দৌড়ে দুই রান নিলেন মুশফিক-মোসাদ্দেক।
কিন্তু নাটকের তখন আরও বাকি। পরের ওভারে হেরাথের দ্বিতীয় বলে কট বিহাইন্ড হয়ে গেলেন মোসাদ্দেক। জয় তখন এত কাছে, ওই আউট গ্যালারির উচ্ছ্বাস থামাতে পারল না। দুই বল পরেই হেরাথকে স্কয়ার লেগে সুইপ করে দুই রান নিয়ে নিলেন মিরাজ। দৌড় শেষ করে তাঁর সঙ্গী মুশফিকের সে কী উচ্ছ্বাস! ৪ উইকেটে জিতেছে তাঁর দল। কলম্বোর পি সারায় শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে নিজেদের শততম টেস্ট জিতল বাংলাদেশ।
অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের পর ইতিহাসের চতুর্থ দেশ হিসেবে শততম টেস্টে জয় পেল বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এটি বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়, যেটি এল ১৮তম বারের চেষ্টায়।
টেস্টে বাংলাদেশ এর আগে রান তাড়া করে জিতেছে মাত্র দুবার। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে গ্রেনাডায় ২১৫ রানের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নামা বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল ৪ উইকেটে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে মিরপুর টেস্টে জিম্বাবুয়ের দেওয়া ১০১ রানের লক্ষ্যটা অবশ্য তাড়া করতে নেমে ঘাম ছুটে গিয়েছিল বাংলাদেশের, জিতেছিল ৩ উইকেটে। এ জয়ের মাহাত্ম্য নিঃসন্দেহে আগের দুটিকে ছাড়িয়ে গেছে।
অথচ দিনটা শুরু হয়েছিল একটা শঙ্কা জাগিয়ে। আগের দিন অপরাজিত থাকা শ্রীলঙ্কার দুই ব্যাটসম্যান দিলরুয়ান পেরেরা-সুরঙ্গা লাকমলকে ফেরাতেই আরও ১৩.২ ওভার লেগে যায় বাংলাদেশের। কিন্তু তার আগেই আগের দিনের ১৩৯ লিডের সঙ্গে আরও ৫১ রান যোগ করে ফেলে শ্রীলঙ্কা। মিস ফিল্ডিংয়ে রান নিতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়েছেন পেরেরা। তবে এর আগেই পেয়ে যান নিজের চতুর্থ টেস্ট ফিফটি। পরের ওভারেই সাকিবের দ্বিতীয় বলে মোসাদ্দেকের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন সুরঙ্গা লাকমল। নবম উইকেট জুটিতে দুজন যোগ করেছেন ৮০ রান। ৮ উইকেটে দিন শুরু করা শ্রীলঙ্কা অলআউট হলো ৩১৯ রানে। বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৯১। সেটা তাড়া করতে নেমে ৮ ওভারের মধ্যেই ২২ রানে ২ উইকেট নেই বাংলাদেশের। শঙ্কা নয় তো কী!
রঙ্গনা হেরাথকে কেন ওভাবে ডাউন দ্য উইকেটে মারতে গেলেন সৌম্য সরকারই ভালো বলতে পারবেন। বাঁহাতি ওপেনারের আত্মাহুতির পর ফিরে যান ইমরুল কায়েসও। ‘বার্থ ডে বয়’ হেরাথের পরের বলেই স্লিপে গুনারত্নেকে ক্যাচ দিয়ে শূন্য রানে ফেরেন ইমরুল।
কিন্তু শুরুর ধাক্কা সামলে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ২ উইকেটে ৩৮ রান তুলে লাঞ্চে যায় বাংলাদেশ। লাঞ্চের পর এসে যেন অন্য এক বাংলাদেশ! তামিম-সাব্বির খেলতে থাকেন স্বচ্ছন্দে। ৮৭ বলে টেস্টে নিজের ২২তম ফিফটিটিও পেয়ে যান তামিম। সবচেয়ে বড় কথা সাব্বির রহমানের সঙ্গে জুটি গড়ে বাংলাদেশের শততম টেস্ট জয়ের স্বপ্নটা উজ্জ্বল করে তোলেন। তবে জেতার জন্য যখন ৬০ রান দরকার, পেরেরাকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হয়ে যান তামিম। লং অনে দুর্দান্ত ক্যাচ ধরেছেন চান্ডিমাল। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ১৮ রান দূরে তখন বাংলাদেশ ওপেনার। ভেঙে যায় ১০৯ রানের জুটি।
তামিমকে দুর্দান্ত সঙ্গ দিচ্ছিলেন সাব্বির। কিন্তু সঙ্গী হারিয়ে তিনিও যেন অধৈর্য হয়ে গেলেন। পেরেরাকে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লুর ফাঁদে পড়লেন। মাঠের আম্পায়ার শ্রীলঙ্কানদের আবেদনে সাড়া না দিলেও রিভিউতে বাঁচতে পারেন সাব্বির।
পরপর দুই ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে আবার কিছুটা চাপে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। দায়িত্বটা গিয়ে পড়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যান মুশফিক আর সাকিবের কাঁধে। ৪ উইকেটে ১৫৬ রান নিয়ে চা বিরতিতে যাওয়া বাংলাদেশ বিরতির পর এসে আবার একটা ধাক্কা খায়। সেই পেরেরার বলেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্লেড-অন হয়ে যান সাকিব। ২ উইকেটে ১৩১ থেকে ৫ উইকেটে ১৬২ হয়ে যায় বাংলাদেশ! পি সারার শ্রীলঙ্কান সমর্থকেরাও যেন নতুন আশায় একটু নড়েচড়ে বসলেন। টেলিভিশন পর্দায় বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের চিন্তিত মুখ! সেই মুখে আরও অন্ধকার নেমে যখন পেরেরার বলেই মুশফিককে এলবিডব্লিউ দিয়ে দেন আম্পায়ার সুন্দরম রবি। রিপ্লে নিয়ে অবশ্য বেঁচে যান মুশফিক।
শেষ পর্যন্ত মিরাজকে সঙ্গী করে সেই মুশফিক হাসি মুখেই মাঠ ছাড়লেন। কোচ হাথুরুসিংহের মুখে অন্ধকার সরে গিয়ে তখন আলো ঝলমলে হাসি। হাসি বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমে, হাসি পুরো বাংলাদেশের মুখে।
EmoticonEmoticon